জৈব রসায়ন কী এবং এর ইতিহাস কীভাবে শুরু হয়? কার্বন-ঘটিত যৌগের বৈশিষ্ট্য, বিভিন্ন প্রকার জৈব যৌগ এবং জীবনের বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তাদের অপরিহার্য ভূমিকা সম্পর্কে জানুন।
জৈব রসায়ন কী?
জীবনের সমস্ত রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জৈব যৌগের গুরুত্ব অপরিসীম। জৈব রসায়ন হলো কার্বন-ভিত্তিক যৌগের গঠন, ধর্ম, প্রস্তুতি ও বিক্রিয়া নিয়ে অধ্যয়নকারী রসায়নের শাখা। এর শুরু হয় আঠারো শতকের শেষের দিকে, যখন বিজ্ঞানীরা উদ্ভিদ ও প্রাণিজগৎ থেকে প্রাপ্ত নানা পদার্থের রাসায়নিক গঠন ও ধর্ম নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
প্রাচীনকাল থেকে মানুষ উদ্ভিদ ও প্রাণী থেকে নানা জৈব পদার্থ সংগ্রহ করে খাদ্য, ঔষধ, প্রসাধনী, পোশাক ও অন্যান্য কাজে ব্যবহার করে আসছে। শুরুতে এই পদার্থগুলিকে ‘জৈব পদার্থ’ বলা হত। পরবর্তীতে পরীক্ষাগারে এদের উৎপাদন ও বিশ্লেষণ শুরু হয় এবং বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, এই সব যৌগে কার্বনের উপস্থিতি অপরিহার্য।
জৈব রসায়নের ইতিহাস ও গুরুত্ব
বহু জৈব যৌগ বিশ্লেষণের মাধ্যমে ল্যাঁভয়সিয়ে প্রথম প্রমাণ করেন, প্রতিটি জৈব যৌগেই কার্বন পরমাণু থাকে। দীর্ঘদিন পরীক্ষাগারে জৈব যৌগ প্রস্তুত করা সম্ভব না হলেও, ১৮২৮ সালে বিঞ্জানী ভোলার অজৈব লবণ অ্যামোনিয়াম সায়ানেট উত্তপ্ত করে ইউরিয়া প্রস্তুত করেন, যা ছিল প্রথম কৃত্রিমভাবে তৈরি জৈব যৌগ। এই আবিষ্কার জৈব রসায়নের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী।
আজকের দিনে জানা গেছে, জৈব যৌগের সংখ্যা লক্ষাধিক, যা পৃথিবীর অন্য কোনো মৌলের তুলনায় বহুগুণ বেশি। এরা এমন বিশেষ বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে যা অজৈব যৌগে দেখা যায় না।
জৈব রসায়নের সংজ্ঞা
জৈব যৌগ বলতে বোঝায় সেই সমস্ত যৌগ যা কার্বন পরমাণু ধারণ করে এবং যেখানে কার্বনের ক্যাটিনেশন ধর্ম, সমাবয়বতা ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট থাকে। যেমন- কার্বনের অক্সাইড, বাইকার্বোনেট, কার্বোনেট, হাইড্রোজেন সায়ানাইড এবং ধাতব সায়ানাইড লবণ বাদ দিয়ে অন্য সব কার্বন-ঘটিত যৌগ।
জৈব রসায়নের কাজ হলো এসব জৈব যৌগের গঠন, ধর্ম, প্রস্তুতি ও বিক্রিয়া নিয়ে অধ্যয়ন।
জীবনক্রিয়ায় জৈব যৌগের ভূমিকা
- প্রাণী ও উদ্ভিদের গঠন: জীবদেহের অধিকাংশ অংশ জৈব যৌগ দ্বারা গঠিত।
- পুষ্টি ও বৃদ্ধি: প্রাণীর খাদ্য মূলত কার্বোহাইড্রেট (শর্করা), ফ্যাট (স্নেহজাতীয় খাদ্য) ও প্রোটিন থেকে গঠিত, যা জৈব যৌগ। উদাহরণস্বরূপ- চাল, গম, ডাল, তেল, মাংস ইত্যাদি।
- পাচন ও শোষণ: খাদ্য সরাসরি দেহে শোষিত হয় না, পাচন প্রক্রিয়ায় জৈব রসায়ন ঘটে সরল যৌগে রূপান্তরিত হয়, যা কোষে শোষিত হয়।
- এনজাইম ও উৎসেচক: শ্বসন, বিপাক ও নানা রাসায়নিক বিক্রিয়ায় প্রোটিন জাতীয় এনজাইম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- ভিটামিনের গুরুত্ব: শরীরে নানা রোগ প্রতিরোধে ভিটামিন প্রয়োজন, যা জৈব যৌগ।
- রক্ত ও শক্তি: হিমোগ্লোবিন একটি লোহাঘটিত প্রোটিন যা অক্সিজেন পরিবহন করে। শক্তির উৎস অ্যাডিনোসিন ট্রাই-ফসফেট।
- রোগ নিরাময়: কুইনাইন, পেনিসিলিন, ক্লোরোমাইসিটিনসহ নানা ওষুধ জৈব যৌগ।
- বংশধারা সংরক্ষণ: ডি-অক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড (DNA) ও রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড (RNA) জীববৈজ্ঞানিক বংশপরম্পরা রক্ষায় অপরিহার্য।
জৈব রসায়ন হলো জীবনের মূল ভিত্তি, যা জীবজগতে ঘটে যাওয়া প্রতিটি রাসায়নিক প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু। জীবদেহের গঠন, খাদ্যগ্রহণ, শক্তি উৎপাদন, রোগ প্রতিরোধ ও বংশবৃদ্ধি—সবকিছুই জৈব যৌগের মধ্য দিয়ে ঘটে। অতএব, জীবন-ক্রিয়া অব্যাহত রাখতে জৈব রসায়নের গুরুত্ব অপরিসীম এবং এর জ্ঞান আধুনিক জীববিজ্ঞান ও চিকিৎসার জন্য অপরিহার্য।