পর্যায় সারণী বা পিরিয়ডিক টেবিল কী? আধুনিক পর্যায় সারণীর গঠন, শ্রেণিবিন্যাস, বিভিন্ন পর্যায় ও তাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সহজ ও বিস্তারিত তথ্য।
পর্যায় সারণী কাকে বলে ?
পর্যায় সারণী হলো মৌলগুলোকে ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক সংখ্যা অনুসারে সাজিয়ে তৈরি একটি তালিকা, যা আধুনিক রসায়নে মৌলগুলোর গঠন ও বৈশিষ্ট্য বুঝতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আধুনিক পর্যায় সারণীকে দীর্যাকার পর্যায় সারণীও বলা হয়, যেখানে অনুভূমিক রেখাগুলোকে পর্যায় (Period) এবং উল্লম্ব কলামগুলোকে শ্রেণি (Group) বলা হয়।
আধুনিক পর্যায় সারণীর গঠন ও শ্রেণীবিন্যাস
বর্তমান পর্যায় সারণীতে মোট সাতটি পর্যায় রয়েছে। প্রতিটি পর্যায় অনুভূমিক সারি হিসেবে সাজানো হয় এবং ইংরেজি সংখ্যা (1, 2, 3, …) দ্বারা চিহ্নিত। পর্যায়ের শুরু হয় সাধারণত ক্ষারধাতু দিয়ে এবং শেষ হয় নিষ্ক্রিয় গ্যাস দিয়ে। তবে প্রথম ও সপ্তম পর্যায়ে কিছু ব্যতিক্রম দেখা যায়।
উলম্ব কলামগুলোকে শ্রেণি বা গোষ্ঠী বলা হয়, মোট নয়টি শ্রেণি থাকে। শ্রেণিগুলোকে রোমান সংখ্যা দিয়ে I থেকে VIII পর্যন্ত ও শেষ শ্রেণিকে ‘O’ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। এক্ষেত্রে একই শ্রেণির মৌলগুলোকে এক পরিবারের সদস্য হিসেবে গণ্য করা হয়, কারণ এদের রাসায়নিক ধর্ম সাধারণত সাদৃশ থাকে।
তবে সরাসরি শ্রেণীবিন্যাসে কিছু অসংগতি থাকে। যেমন, I শ্রেণিতে Na ও K ক্ষার ধাতুর সঙ্গে Cu, Ag, Au মুদ্রা ধাতু থাকা; আর VII শ্রেণিতে F, Cl অধাতুর সঙ্গে Mn ধাতুও থাকা। এই অসঙ্গতি দূর করার জন্য প্রতিটি শ্রেণি A ও B উপশ্রেণিতে ভাগ করা হয়।
বিভিন্ন পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য
- প্রথম পর্যায় (পারমাণবিক সংখ্যা ১-২):
হ্রস্বতম পর্যায়, যেখানে শুধুমাত্র দুই মৌল থাকে — হাইড্রোজেন (H) ও হিলিয়াম (He)। - দ্বিতীয় পর্যায় (পারমাণবিক সংখ্যা ৩-১০):
ক্ষুদ্র পরিসরের ৮টি মৌল, যাদের “সেতু-মৌল” বলা হয়। - তৃতীয় পর্যায় (১১-১৮):
আবারো ৮টি মৌল, যাদের “প্রতিনিধিত্বমূলক মৌল” বলা হয়। - চতুর্থ পর্যায় (১৯-৩৬):
দীর্ঘ পর্যায়, ১৮টি মৌল নিয়ে গঠিত। - পঞ্চম পর্যায় (৩৭-৫৪):
আরেকটি দীর্ঘ পর্যায়, ১৮টি মৌল। - ষষ্ঠ পর্যায় (৫৫-৮৬):
অত্যন্ত দীর্ঘ পর্যায়, যেখানে মোট ৩২টি মৌল থাকে। - সপ্তম পর্যায় (৮৭-১০৯):
অসম্পূর্ণ পর্যায়, বর্তমানে ২৩টি মৌল অন্তর্ভুক্ত।
পর্যায় সারণীর আধুনিক সূত্র ও ইলেকট্রন বিন্যাস
আধুনিক পর্যায় সারণীর মূল ভিত্তি হলো বহির্কক্ষের ইলেকট্রন সজ্জা। মৌলগুলোর পরমাণুর নিউক্লিয়াসে ক্রমান্বয়ে প্রোটন যুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রনগুলো নির্দিষ্ট শক্তি খোলকে সাজতে থাকে। প্রতিটি খোলকে ইলেকট্রনের সংখ্যা ও বিন্যাস মৌলগুলোর রাসায়নিক ধর্ম নির্ধারণ করে।
উদাহরণস্বরূপ:
- হাইড্রোজেন (H) নিউক্লিয়াসে ১টি প্রোটন, তাই ১টি ইলেকট্রন K-শক্তি খোলকে থাকে।
- হিলিয়াম (He) নিউক্লিয়াসে ২টি প্রোটন, ২টি ইলেকট্রন একই K-খোলকে পূর্ণ করে।
- লিথিয়াম (Li) থেকে ১০ পর্যন্ত মৌলগুলোর ইলেকট্রন দ্বিতীয় খোলক L-তে সাজানো হয়।
- সোডিয়াম (Na) থেকে পরবর্তী মৌলগুলোতে ইলেকট্রন তৃতীয় খোলক M-এ চলে যায়।
এই ইলেকট্রন বিন্যাসের সাদৃশ্য অনুযায়ী মৌলগুলো একই গোষ্ঠীতে অবস্থান করে, যাদের রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য প্রায় একই রকম হয়।
শ্রেণী বা গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য
যেসব মৌলের বহির্কক্ষের ইলেকট্রন সংখ্যা একই, তারা একই গোষ্ঠীতে রাখা হয়। যেমন, Na (সোডিয়াম) ও Li (লিথিয়াম) উভয়ের বহির্কক্ষে ১টি ইলেকট্রন থাকে এবং এরা উভয়ই ক্ষারধাতু। অন্যদিকে, Ne (নিওন) ও Ar (আর্গন) নিষ্ক্রিয় গ্যাস, যাদের বহির্কক্ষ পূর্ণ, ফলে এদের রাসায়নিক ধর্মও সাদৃশ্যপূর্ণ।
পর্যায় সারণী আধুনিক রসায়নের এক মৌলিক হাতিয়ার। এটি মৌলগুলোর পারমাণবিক সংখ্যা, ইলেকট্রন বিন্যাস ও রাসায়নিক ধর্ম বুঝতে সাহায্য করে। সঠিক শ্রেণীবিন্যাস ও পর্যায়ের মাধ্যমে বিভিন্ন মৌলের বৈশিষ্ট্য ও পারস্পরিক সম্পর্ক সহজেই বোঝা যায়, যা রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানে অপরিহার্য।